/ উদ্যোক্তা / যেসব কারণে স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগে আস্থার সংকট
উদ্যোক্তা
যেসব কারণে স্টার্টআপে বিদেশি বিনিয়োগে আস্থার সংকট
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০২২
দেশের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। এ খাতে গত এক দশকে বিনিয়োগ এসেছে ৮০ কোটি ডলারের বেশি, যার বেশির ভাগই বিদেশি বিনিয়োগ। বিদেশি এ বিনিয়োগ এসেছে ভিনদেশে নিবন্ধিত কোম্পানির মাধ্যমে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশের ব্যবসায়িক নীতির কারণে স্টার্টআপে সরাসরি বিনিয়োগে আস্থা পায় না বিনিয়োগকারীরা।
দেশের শীর্ষ স্টার্টআপগুলোর বেশির ভাগেরই সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে কোম্পানি নিবন্ধন করা আছে। এই স্টার্টআপগুলোর উদ্যোক্তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ পেতেই তাঁরা দেশের বাইরে কোম্পানি নিবন্ধন করেছেন। এর পেছনে মূলত তিনটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তাঁরা। সেগুলো হলো, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য ‘এক্সিট প্ল্যান’ (বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার উপায়) নেই; বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট এবং স্টার্টআপ–সহায়ক ব্যবসায়িক নীতির অভাব।
স্টার্টআপের বর্তমান অবস্থা:
দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসেল পার্টনার গত জুলাইয়ে ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম ২০২১-২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে এখন ১ হাজার ২০০টির বেশি সচল স্টার্টআপ রয়েছে।
২০২১ ও ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশি স্টার্টআপে ৫০ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এসেছে। এর মধ্যে ৪৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২৩২টি চুক্তি থেকে ৮০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।
দেশে স্টার্টআপগুলো বিকাশে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের সহায়ক মনোভাব প্রয়োজন বলে মনে করছে লাইটক্যাসেল। তাদের ভাষ্যমতে, এ-সংক্রান্ত নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোয় অসংগতি আছে। আর্থিক বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়াটাও স্টার্টআপগুলোর জন্য উল্লেখযোগ্য বাধা।
বাংলাদেশে ২০২১ সালে স্টার্টআপে বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যান্য দেশের চেয়ে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্টার্টআপে বিনিয়োগে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর, চীন, ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের পর আছে পাকিস্তান। এই সাতটি দেশের মধ্যে ২০২০-২১ সালে সবচেয়ে বেশি ৯৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বেড়েছে বাংলাদেশে। এরপরও জিডিপি অনুপাতে তা মাত্র শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ।
স্টার্টআপে যেসব বিনিয়োগ আসছে, তার ৯৫ শতাংশই বিদেশি। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ফিনটেক (ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি), লজিস্টিক ও মোবিলিটি এবং ই-কমার্স ও রিটেইলে। এগুলোর মধ্যে শুধু ফিনটেকই বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৫০ কোটি ডলারের বেশি।
কোম্পানি নিবন্ধন কেন বিদেশে:
ভ্রমণবিষয়ক স্টার্টআপ ‘গোজায়ান’-এর সিঙ্গাপুরে কোম্পানি নিবন্ধন করা আছে। এ বছরের শুরুতে পাকিস্তানের স্টার্টআপ ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চারকে কিনে নেয় তারা। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানো বা বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান কেনার ক্ষেত্রে টাকা পাঠানো নিয়ে ঝামেলা প্রসঙ্গে গোজায়ান জানায়, সিঙ্গাপুরে তাদের নিবন্ধিত কোম্পানি হয়েই ফাইন্ড মাই অ্যাডভেঞ্চারকে কিনেছে তারা।
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর সমস্যার কারণেই কোম্পানি নিবন্ধন দেশের বাইরে করা হয় বলে জানান শিক্ষাপ্রযুক্তি–বিষয়ক স্টার্টআপ ‘শিখো’-এর প্রধান নির্বাহী শাহির চৌধুরী। তবে তিনি বলেন, অন্য দেশে নিবন্ধন থাকলেও তা বাংলাদেশি কোম্পানি হিসেবেই বিবেচিত হবে। কারণ, ব্যবসা বাংলাদেশ থেকেই পরিচালিত হয়। এ ছাড়া স্টার্টআপগুলোর বিদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও নিবন্ধন আছে।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরাসরি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ভরসা পায় না। ফলে সরাসরি বিনিয়োগ না আসায় বিশ্ববাজারে দেশের ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে না। কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ ‘আইফার্মা’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ফাহাদ ইফাজ বলেন, বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা চায়। আবার একটা পর্যায়ে গিয়ে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ তুলে নিতে চাইবে। কোম্পানি বড় হবে বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠান কিনে নেবে, এমন প্রত্যাশা থেকে তারা স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেওয়া খুব বেশি সহজ নয়। কিন্তু সিঙ্গাপুর, আবুধাবি থেকে সহজে তা পারা যায়।
স্টার্টআপের উদ্যোক্তারা জানান, বিভিন্ন প্রয়োজনে কোম্পানির অংশীদারদের সরাসরি উপস্থিতিরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় অনেক সময়। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সব সময় সরাসরি উপস্থিত থাকতে পারে না। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) স্টার্টআপের জন্য আলাদা কোনো বিভাগ নেই। বিডার নজর উৎপাদনশীল খাতের প্রতি।
এ বিষয়ে বিডার ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, বিডায় স্টার্টআপের জন্য আলাদা কোনো বিভাগ নেই। তবে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ তুলে নেওয়া এখন আগের চেয়ে সহজ হয়েছে।
সর্বশেষ জাতীয় বাজেটে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের টার্নওভার করহার শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি আয়কর রিটার্ন দাখিল বাদে বাকি সব রিপোর্টিং থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করতে তাদের অর্থ ফেরত নেওয়ার পদ্ধতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে সুরক্ষা দিতে আইনি বিধানও করতে হবে।
কী হতে পারে:
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ‘এশিয়ার উন্নয়নবিষয়ক পূর্বাভাস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, ভৌত অবকাঠামোতে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকলেও সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ডিজিটাল উদ্যোগের পরিপূরক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে।
মানসিকতা ও সংস্কৃতিগত সমস্যার কথা উঠে এসেছে স্টার্টআপগুলোর উদ্যোক্তাদের কথাতেও। তাঁরা জানান, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো স্টার্টআপবান্ধব নয়। এ কারণে নতুন উদ্যোগের জন্য ঋণ পেতেও জটিলতার মুখে পড়তে হয়।
তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ডিনেট’ ও ‘আই সোশ্যাল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী অনন্য রায়হান বলেন, বাংলাদেশে কোম্পানি একীভূত ও হাতবদল করা সহজ নয়। স্টার্টআপের ক্ষেত্রে ঘন ঘন মালিকানা বদল হয়। এতে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেসি) উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই স্টার্টআপবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য আরজেসি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের আরও উদ্যোগী হওয়া দরকার।
স্টার্টআপগুলোর সরাসরি নিবন্ধন না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগের মূলধন থেকে সরকারের যে কর পাওয়ার কথা, তা কমে যাবে বলে মনে করেন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও প্রাইভেট ইক্যুইটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শামীম আহসান। এ ছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেলে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
শামীম আহসান বলেন, বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের বিপরীতে মুনাফা তুলে নিতে চাইলে সহজে তা পারে না, তাই বেশির ভাগ কোম্পানি দেশের বাইরে নিবন্ধনে আগ্রহী। সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার মতো সরকারি নীতিসহায়তার মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারলে স্টার্টআপগুলোর জন্য তহবিল পাওয়া আরও সহজ হবে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারে কিছু প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা গেলে বিনিয়োগকারীদের স্টার্টআপে বিনিয়োগে আস্থা বাড়াবে।
ব্যবসাবান্ধব আচরণ ও কোম্পানি আইনের দুর্বলতার কারণে বিনিয়োগকারীরা স্টার্টআপে বিনিয়োগে আগ্রহ পায় না বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও কোম্পানি আইনবিশেষজ্ঞ তানজিব উল আলম। স্টার্টআপগুলোর শেয়ারবাজারে আসা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে আসতে হলে যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে টানা তিন বছর মুনাফায় থাকতে হয়। দেশের স্টার্টআপগুলো এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি।
টেকসই স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরির উদ্দেশ্যে সরকারি মালিকানায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি হিসেবে স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের একটি সংস্থা হিসেবে তারা কাজ করছে। এ কোম্পানি এখন পর্যন্ত ১৭টি স্টার্টআপে ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
স্টার্টআপের জন্য সহায়ক পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাইলে স্টার্টআপ বাংলাদেশ এক লিখিত বক্তব্যে জানায়, তারা স্টার্টআপ নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া স্টার্টআপের নীতিগত বিষয় নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গেও তারা কাজ করছে।
স্টার্টআপদের ব্যবসা গঠন ও পরিচালনার বিষয়গুলোকে সহজ ও দ্রুতগামী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে স্টার্টআপদের দ্রুত সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা উইং গঠন করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে সরকারের এই কোম্পানি।