মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কায় বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ ব্যাপকহারে কমে গেছে। ২০২০ সালে মোট ৩৩৭ কোটি ৮৫ লাখ (৩.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক ২০১৯ সালের চেয়ে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ কম। আর ২০১৮ সালের চেয়ে কম প্রায় ২৬ শতাংশ।
২০১৯ সালে ৩৯৯ কোটি ১৫ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে এসেছিল ৪৫৪ কোটি ৬২ লাখ ডলার; যা একক বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ।
ওই বছরে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপানের কোম্পানি জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা।
২০২০ সালে নিট এফডিআই কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। ২০২০ সালে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৫৬ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। ২০১৯ ও ২০১৮ সালে নিট এফডিআইয়ের অঙ্ক ছিল যথাক্রমে ২৮৭ কোটি ৩৯ লাখ ও ৩৬১ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ঋণ’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ঈদের ছুটির আগে সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিনিয়োগপ্রবাহ আগের অবস্থায় আসতে সময় লাগবে। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিবেদনে বিদেশি বিনিয়োগে এই ধসের জন্য করোনাভাইরাস মহামারিকে দায়ী করে বলা হয়েছে, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। তার প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগে পড়েছে।’
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশে আগের মতোই বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে প্রতিবেদনে আশা করা হয়েছে।
গত ২১ জুন জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাড ‘বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদন ২০২১’- প্রকাশ করেছে। তাতেও বাংলাদেশে এফডিআই কমার তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে। উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিনিয়োগপ্রবাহ আগের অবস্থায় আসতে সময় লাগবে।
আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মোট ২৫৬ কোটি ৪০ লাখ (২.৫৬ বিলিয়ন) ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে বাংলাদেশে। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কম। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৮৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশে যে নিট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে সেই তথ্যের উপর ভিত্তি করে এফডিআইয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে আঙ্কটাড।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলো তিনভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে। ১. মূলধন হিসাবে নগদ বা শিল্পের যন্ত্রপাতি হিসাবে, বাংলাদেশে ব্যবসা করে অর্জিত মুনাফা বিদেশে না নিয়ে পুনবিনিয়োগ করে এবং এক কোম্পানি অন্য কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করতে পারে।
এ তিন পদ্ধতির যে কোনোভাবে দেশে বিনিয়োগ আসলে তা এফডিআই হিসাবে গণ্য করা হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক বছরের এফডিআইয়ের যে তথ্য প্রকাশ করে তাতে বিদেশি বিনিয়োগে এখনও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বাংলাদেশ।
৩০ জুলাই শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে (২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১ মে) মোট ৩২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার এফডিআই পেয়েছে বাংলাদেশ; যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি।
এই ১১ মাসে নিট এফডিআইয়ের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১২৬ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মোট ২৯৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার এসেছিল। নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ১১৯ কোটি ১০ লাখ ডলার।
বিভিন্ন খাতে মোট যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ দেশে নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অংককে নিট এফডিআই বলা হয়।
করোনার ধাক্কা বিদেশি বিনিয়োগে
মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম পোশাকপল্লি। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালে বিদেশ থেকে মূল পুঁজি আনা ও কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ ব্যাপকভাবে কমেছে। এ কারণে সার্বিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মূল পুঁজি বিনিয়োগ বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ কমেছে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
মূলত মূল পুঁজি ও অর্জিত মুনাফা থেকে বিনিয়োগ বেশি হারে না বাড়ায় এবং এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় সার্বিকভাবে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে।
২০১৯ সালে এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণের পরিমাণ ছিল ৬০ কোটি ২৯ লাখ ডলার। গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি ৫২ লাখ ডলারে।
২০২০ সালে মোট বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ১৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যাংকিং খাতে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, টেক্সটাইলে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, টেলিকমিউনিকেশনে ১০ দশমিক ১ শতাংশ, খাদ্যে ১৩ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ৩৪ দশমিক ৭ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে।
গত বছর দেশে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ মূল পুঁজি, ৬১ দশমিক ১ শতাংশ মুনাফা থেকে পুনরায় বিনিয়োগ এবং ৬ শতাংশ এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানির ঋণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে মোট ২ হাজার ৫৫০ কোটি ৮৫ লাখ ডলার এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে মূল পুঁজি এসেছে ৯১২ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। মুনাফা থেকে ও ঋণ থেকে বিনিয়োগ হয়েছে বাকি ৬৪ দশমিক ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ মূল বিনিয়োগ মাত্র এক তৃতীয়াংশ।
এই সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সিঙ্গাপুর। তারা মোট বিনিয়োগের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ করেছে। তৃতীয় অবস্থানে নেদারল্যান্ডের বিনিয়োগ ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, চীনের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, মিশরের ৬ দশমিক ২ শতাংশ, যুক্তরাজ্যের ৬ দশমিক ১ শতাংশ, হংকংয়ের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অন্যান্য দেশগুলোর ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগের নাজুক অবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের চেম্বার অ্যামচেমের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে এফডিআইয়ের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং।
‘বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে আমরা এখনও আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমরা আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। এটা খুবই দুখঃজনক।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ এর অর্থনীতির আকারের বিবেচনায় অনেক কম। এর মূল কারণ অবকাঠামোর ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক কূটনীতির অভাব।
‘বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলো সরকার বাস্তবায়ন করছে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে। এসব প্রকল্প পিপিপির আওতায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমেও হতে পারত। সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ত।’
এরশাদ আহমেদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। দেশি বিনিয়োগও কম হচ্ছে। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগও কম।
‘এছাড়া করোনার কারণে গত বছর ব্যবসা-বাণিজ্য একেবারেই স্থবির ছিল। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই এফডিআই কমেছে।’
‘করোনার প্রকোপ কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। ফলে এ বছর বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণ দ্রুত শেষ হলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে,’ বলেন তিনি।
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে না।
‘গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে; জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। এই কয়েক বছরে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়েনি।’
তিনি বলেন, ২০২০ সালে এফডিআই কমেছে মূলত কোভিডের কারণে। করোনায় বিশ্ব বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায় পুঁজির চলাচল একেবারে স্থবির ছিল। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশেও পুঁজি বিনিয়োগ কম হয়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দেশে বিনিয়োগ পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে হবে। বিদেশিদের জন্য বরাদ্দ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ার কথা। কিন্তু বাড়ছে না কেন। এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা উচিত বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর।